সারা বিশ্বে মহিলাদের ক্যান্সারজনিত মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে ব্রেস্ট ক্যান্সার। প্রতি ১৪ সেকেন্ডে পৃথিবীর কোথাও না কোথাও একজন নারী ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন। বাংলাদেশেও ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে। প্রতি বছর আমাদের দেশে প্রায় সাত হাজার নারী এই রোগে মারা যান। দিন দিন এই রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ার মূল কারণ হচ্ছে ব্রেস্ট ক্যান্সার সম্পর্কে আমাদের অসতর্কতা এবং অসচেতনতা।
ব্রেস্ট ক্যান্সার এমন একটি রোগ যেখানে স্তনের কোষগুলি অনিয়ন্ত্রিতভাবে বৃদ্ধি পায়। এটি পুরুষ এবং মহিলা উভয়ের মধ্যেই ঘটতে পারে, যদিও এটি মহিলাদের মধ্যেই অনেক বেশি হয়। দ্রুত চিহ্নিতকরণে এই রোগে নিরাময়ের সম্ভাবনা প্রায় শতভাগ। নিয়মিত ব্রেস্ট-এর সেল্ফ-এক্সাম এবং বছরে অন্তত একবার অভিজ্ঞ চিকিৎসকের দ্বারা ব্রেস্ট স্ক্রিনিং করালে এই রোগ থেকে অনেকটাই ঝুঁকিমুক্ত থাকা সম্ভব। ব্রেস্ট ক্যান্সার আরও বিস্তারিত জানতে নিম্নোক্ত লেখাগুলো পড়ুন।
ব্রেস্ট ক্যান্সার একজন মানুষের শরীরের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের উপরেও ভয়ঙ্কর প্রভাব ফেলে। তাই, যারা ব্রেস্ট ক্যান্সারের শিকার, তাদের পরিবার ও প্রিয়জনদের বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে যেন তারা আক্রান্ত ব্যক্তিকে সঠিক মানসিক ও শারীরিক সমর্থন দিতে পারে।
প্রাথমিক পর্যায়েই সনাক্তকরণে ব্রেস্ট ক্যান্সার নিরাময়ের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। নিয়মিত ম্যামোগ্রাম, সেল্ফ-এক্সাম এবং অভিজ্ঞ চিকিৎসকের দ্বারা ব্রেস্ট স্ক্রিনিং-এর মাধ্যমে ব্রেস্ট ক্যান্সার চিহ্নিতকরণ সম্ভব। তবে সেল্ফ-এক্সামের ক্ষেত্রে এটি কীভাবে করতে হয় এবং ব্রেস্ট ক্যান্সারের লক্ষণগুলো কী কী, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানা থাকা প্রয়োজন।
নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা আপনার ব্রেস্ট-হেলথ বা স্তনের স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। ডাক্তারি পরীক্ষার পাশাপাশি ম্যামোগ্রাম ও অন্যান্য স্ক্রীনিং করা হলে, যেকোনো অস্বাভাবিকতা তাড়াতাড়ি ধরা পড়তে পারে। ডাক্তারদের নিয়মিত পরামর্শ নেয়ার ফলে আপনার ক্যান্সার সনাক্তকরণ এবং প্রতিরোধের সম্ভাবনা বাড়ে। এখনই আপনার পরবর্তী স্বাস্থ্য পরীক্ষার সময় ঠিক করুন এবং সুস্থতার পথে এগিয়ে যান।
ব্রেস্ট ক্যান্সারের চিকিৎসা সব সময় একরকম হয় না। ক্যান্সারের পর্যায় এবং ধরণ অনুযায়ী চিকিৎসার ধরণ পরিবর্তিত হয়— যেমন অস্ত্রোপচার, রেডিয়েশন, কেমোথেরাপি বা টার্গেটেড থেরাপি। আপনার জন্য কোনটি সবচেয়ে ভালো হবে, তা নির্ধারণের জন্য ডাক্তারদের সঙ্গে পরামর্শ করুন। চিকিৎসার প্রতিটি ধাপ সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং পছন্দের বিকল্পগুলি জানা আপনাকে সুস্থতার পথে আরও আত্মবিশ্বাসী করবে।
স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায় এমন বিভিন্ন কারণ, যেমন বংশগত, জীবনধারা এবং পরিবেশগত প্রভাব সম্পর্কে জানুন।
মহিলাদের স্তন ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি পুরুষদের চেয়ে বেশি।
যদি কারো পূর্বে একটি স্তনে ক্যান্সার হয়ে থাকে, তবে তার অন্য স্তনেও ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
যদি কারও মা, বোন অথবা মেয়ের স্তন ক্যান্সার হয়ে থাকে তবে তার স্তনে ক্যান্সারের আশঙ্কা অনেক গুণ বেশি। তবে স্তন ক্যান্সার ধরা পড়েছে, এমন ব্যক্তিদের অধিকাংশরই কোনো পারিবারিক ইতিহাস নেই।
তেজস্ক্রিয়/বিকিরণ রশ্মি দিয়ে চিকিৎসা করলে পরবর্তী জীবনে তার ব্রেস্ট ক্যান্সার হবার সম্ভাবনা থাকে।
মাত্রাতিরিক্ত ওজন (অথবা মোটা) ব্রেস্ট ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। চর্বি ইস্ট্রোজেন হরমোন উৎপাদন করে, যা ক্যান্সারের জ্বালানি হিসেবে কাজ করে।
১২ বছর বয়স হওয়ার আগে ঋতুস্রাব হলে তা ব্রেস্ট ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়।
৫৫ বছর বয়সের পর যদি মেনোপজ হয়, তা ব্রেস্ট ক্যান্সারের কারণ হতে পারে।
৩৫ বছরের পরে যদি কোনো মহিলা প্রথম সন্তান জন্ম দেয় তবে স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
মেনোপজ-এর লক্ষণ ও উপসর্গসমূহের জন্য যেসব মহিলা ইস্ট্রোজেন ও প্রজেস্টেরনে মিলিত হরমোনের চিকিৎসা নেন, তাদের ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি বেশি থাকে।
অতিরিক্ত মদ্যপান স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।
এসকল ঝুঁকি থাকলে নারীদের সতর্ক থাকতে হবে ও নিয়মিত স্তন পরীক্ষা করতে হবে।
স্তনে গুটি, আকারের পরিবর্তন, ত্বকে ঢেউ বা নিপল থেকে নির্গমনের মতো প্রাথমিক সতর্ক সংকেত এবং লক্ষণগুলি সম্পর্কে জানুন।
স্তন বা হাতের নিচে বগলে চাকা বা দল অনুভব করা। পিরিয়ডের সময় মেয়েদের এমন লক্ষণ দেখা দিতে পারে এবং পিরিয়ড সাইকেল শেষে এই লক্ষণ চলে যায়। কিন্তু তা স্থায়ী হলে পরীক্ষা করা প্রয়োজন। এ ধরনের চাকায় বা দলায় সাধারণত ব্যথা অনুভূত হয় না, হালকা খোঁচার মত লাগে।
বগলের কোথাও নির্দিষ্ট কারণ ছাড়াই যদি ফুলে ওঠে।
স্তনের কোথাও লালচে ভাব বা ব্যথা অনুভব করা।
স্তনের আকার, রঙ, চামড়ায় বা তাপমাত্রায় কোনরকম পরিবর্তন দেখা দিলে, যেমন কুঁচকে যাওয়া, গর্তে ঢুকে যাওয়া, ঘা হওয়া, রঙ বদলে যাওয়া, স্তনের চামড়া ওঠা ইত্যাদি যদি দেখা দেয় তবে তা অ্যাডভান্সড ব্রেস্ট ক্যান্সারের লক্ষণ। এ ধরনের লক্ষণ দেখা দিলে দেরি না করে সাথে সাথে ক্যান্সার বিশেষজ্ঞের পরামর্ষ নেয়া প্রয়োজন।
স্তনবৃন্তে (Nipple) বিশেষ কিছু পরিবর্তন দেখা দিতে পারে, যেমন- স্তনবৃন্ত দেবে যাওয়া, চুলকানি, জ্বালা পোড়া, খুস্কি অথবা ক্ষত কিংবা ঘা এর উপস্থিতি।
স্তনবৃন্ত থেকে পরিস্কার, রক্ত বা কোন রঙের পাতলা অথবা আঠালো তরল বের হতে পারে।
ব্রেস্ট সেল্ফ-এক্সামের নিয়মাবলী
গোসলের সময় ভেজা চামড়ার উপর আঙুল ছবির মতো চ্যাপ্টা করে ধীরে ধীরে চালনা করতে হবে। বাঁ দিকের স্তনের জন্য ডান হাত ও ডান দিকের স্তনের জন্য বাঁ হাত ব্যবহার করতে হবে। দেখতে হবে কোনো চাকা, গুটি বা শক্ত দলার মতো কিছু অনুভূত হয় কি না।
প্রথমে হাত দু পাশে থাকবে, তারপর হাত দুটি সোজা করে মাথার উপর তুলতে হবে। এবার সতর্কভাবে লক্ষ্য করে দেখতে হবে যে, স্তনবৃন্ত বা অন্য কোনো অংশ ফুলে আছে কি না অথবা কোনো অংশে লালচে ভাব বা টোল পড়া অংশ আছে কি না। এবার কোমরে হাত দিয়ে কোমরে চাপ দিতে হবে। এখন ডান ও বাম স্তন দুটোই ভালোভাবে দেখতে হবে। কোনোরকম অস্বাভাবিক পরিবর্তন চোখে পড়ে কি না। তবে এক্ষেত্রে বলে রাখা প্রয়োজন, খুব কম নারীরই দুটো স্তন দেখতে একই রকম হয়। প্রতিনিয়ত এই পরীক্ষা করলে স্তনের স্বাভাবিক অবস্থা বোঝা যাবে ও অস্বাভাবিক কোনো পরিবর্তন হলে তা চোখে পড়বে।
মাটিতে অথবা বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে পড়তে হবে। এরপর ডান স্তন পরীক্ষার জন্য ডান দিকে ঘাড়ের নিচে একটি বালিশ বা ভাঁজ করা কাপড় দিয়ে উঁচু করতে হবে এবং ডান হাত মাথার পেছনে রাখতে হবে। এবার বাম হাতের আঙুলগুলো চ্যাপ্টা করে ডান স্তনের উপর রাখতে হবে। ঘড়ির কাঁটা ঘোরার দিকে চক্রাকারে হাত ঘোরানো শুরু করতে হবে। এক্ষেত্রে বলে রাখা জরুরি, স্তনের নিচের অংশ কিছুটা শক্ত মনে হতে পারে। এটা স্বাভাবিক বিষয়। এভাবে চক্রাকারে হাত ঘুরে আসার পর স্তনবৃন্তের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। এক ইঞ্চি অগ্রসর হবার পর একইভাবে চক্রাকারে আবার স্তন পরীক্ষা করতে হবে। সবশেষে স্তনবৃন্তকে বৃদ্ধাঙ্গুলি ও তর্জনীর মধ্যে ধরে চাপ দিতে হবে এবং দেখতে হবে কোনো কিছু নিঃসরিত হয় কি না।
স্বাস্থ্যকর জীবনধারা বজায় রাখা, নিয়মিত স্ক্রিনিং করা এবং পারিবারিক ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন থাকার মাধ্যমে ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি কীভাবে কমানো যায় তা বোঝার চেষ্টা করুন।।
লো ফ্যাট ডায়েট স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেক অংশেই কমিয়ে দেয়। অন্যদিকে কপি জাতীয় সবজিও প্রতিরোধ করে স্তন ক্যান্সার। ব্রকলি, ফুলকপি, বাঁধা কপি, টমেটো ইত্যাদি সবজি খাদ্য তালিকায় যোগ করুন। সম্ভব হলে কাঁচাই খান। এগুলো অকালে স্তনে বয়সের ছাপও প্রতিরোধ করবে।
স্তনের আকৃতি সুন্দর রাখতে ও অকালে বুড়িয়ে যাওয়া প্রতিরোধ করতে সঠিক মাপের ব্রা পরিধান জরুরী। তবে সেটা সঠিক নিয়মে। দিনরাত ২৪ ঘণ্টা ব্রা পরে থাকবেন না, এটা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। রাতের বেলা ব্রা ছাড়া থাকার অভ্যাস করুন।
নিজেই নিজের স্তন পরীক্ষা করার নিয়ম জেনে নিন এবং সেটা নিজের ওপরে প্রয়োগ করুন। নিয়মিত নিজের স্তন নিজে পরীক্ষা করবেন। অন্যদিকে, ৪০ বছরের পর বছরে অন্তত একবার ম্যামোগ্রাম করান। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সনোগ্রাম-ও করাতে পারেন।
মদ ও সিগারেটের মত ভয়াল দুটি উপাদান স্তন ক্যান্সারের সম্ভাবনা ২১ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয়। সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে চাইলে এসব থেকে শত হাত দূরে থাকুন।
সপ্তাহে অন্তত ৩ দিন আধা ঘণ্টা করে ব্যায়াম করুন। একে প্রতিদিনের অভ্যাসে পরিণত করতে পারলে আরও ভালো। নিয়মিত ব্যায়াম ওজন নিয়ন্ত্রণ করে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, ইসট্রোজেন লেভেন হ্রাস করে আর এই সবগুলোই কমায় স্তনের অসুখ হবার সম্ভাবনা।
স্তনের আকৃতি সুন্দর করা হোক বা স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধ। ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা খুব জরুরী। আপনার বয়স যেমনই হয়ে থাকুক না কেন, ওজনটি অবশ্যই নিয়ন্ত্রণে রাখবেন।
আরও কিছু ছোটখাট অভ্যাস আছে, যেগুলো আপনাকে বড় ধরণের সমস্যা থেকে মুক্তি দেবে। যেমন স্তনকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখুন, এটা হরেক রকম চর্ম রোগ থেকে দূরে রাখবে। স্তনের আকৃতি বড় বা ছোট করার জন্য বাজারে প্রাপ্ত কোন ধরণের ক্রিম মাখবেন না। পরিবারে ক্যান্সারের ইতিহাস থাকলে জেনেটিক টেস্ট করাতে পারেন। সন্তানকে স্তন্য দান করুন, এটা স্তনের অসুখের ঝুঁকি কমায়।
Copyright © 2024 All rights reserved. Developed by